সাধারণত ক্যানসার কোষগুলো ছড়ায় খুব নীরবে, খুব ধীরে। সেই সঙ্গে রয়েছে আমাদের অসচেতনতা। ফলে অধিকাংশ সময়ই ক্যানসার ধরা পড়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে, যখন আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। রোগী, রোগীর পরিবার, চিকিৎসক—সবাই অসহায়ভাবে শুধু অপেক্ষা করেন চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য। অথচ নিয়মিতভাবে সাধারণ শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শুরুতেই ক্যানসার নির্ণয় করা গেলে ক্যানসারের ভয়াবহতা ও মৃত্যু অনেক ক্ষেত্রে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।

ক্যানসারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাপদ্ধতি

স্তন ক্যানসার
নিজে নিজে পরীক্ষা: বিছানায় শুয়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা গোসলের সময় যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনি নিজেই আপনার স্তন পরীক্ষা করতে পারেন। প্রতি মাসে অন্তত একবার করুন এ পরীক্ষা।
ম্যামোগ্রাফি: কোনো অস্বাভাবিকতা অনুভূত হলে ম্যামোগ্রাম করা যেতে পারে। এটি একধরনের এক্স-রে পরীক্ষা, যার মাধ্যমে ক্যানসারের সূক্ষ্ম¥পরিবর্তন বা ক্ষুদ্র টিউমারও শনাক্ত করা যায়।

এমআরআই: স্তন ক্যানসার নিরীক্ষণে (স্ক্রিনিং) এটি নিয়মিত করা হয় না। তবে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে গেলে এমআরআই করানো জরুরি হতে পারে।

ইউএসজি টেস্ট: এটি স্তনের যেকোনো চাকা, বিশেষ করে ছোট ছোট চাকা নির্ণয় করে এবং চরিত্র সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইউএসজি কোর নিডল বায়োপসি চাকার প্রকৃতি নির্ণয়ে সাহায্য করে।
কোর নিডল বায়োপসি: এটি ক্যানসার কোষ নির্ণয়ের আধুনিক ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা।

জরায়ুমুখ ক্যানসার

এইচপিভি টেস্ট: জরায়ুমুখের ক্যানসারের জন্য দায়ী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)। ফলে এইচিপিভি পরীক্ষার মাধ্যমে এ ক্যানসার শনাক্ত করা যায়।

পেপটেস্ট: রোগীকে শুইয়ে স্পেকুলামের সাহায্যে জরায়ুমুখটি একটু দেখা হয়। এরপর একটি স্প্যাচুলা দিয়ে সেখান থেকে অল্প রস নিয়ে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয়, ক্যানসার কোষ আছে কি না। এটিই পেপটেস্ট।

কলপোস্কপি: এর মাধ্যমে জরায়ু ও জরায়ুমুখের পরিবর্তন বোঝা যায়। প্রয়োজনীয় কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষার মাধ্যমে শুরুতেই ক্যানসার শনাক্ত করা যায়।

কোলন ক্যানসার

কোলনোস্কপি: এ পরীক্ষায় একটি নমনীয় সূক্ষ্ম আলোকনল মলদ্বার দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। এর মাধ্যমে চিকিৎসক পলিপ অথবা ক্যানসারের কোষ পরিষ্কারভাবে দেখতে পারেন। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ৫ থেকে ১০ বছর অন্তত একবার কোলনোস্কপি করা দরকার।

ফেকাল অকাল্ট ব্লাড টেস্ট: এ পরীক্ষার মাধ্যমে মুখের বা মলের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। প্রতি তিন বছর অন্তত একবার এ পরীক্ষা করানো উচিত।

কন্ট্রাস্ট বা অ্যানিমা: এ পরীক্ষা অনেকক্ষেত্রে এখনো কোনো কোনো কোলনের কোষ নির্ণয়ে কাজে লাগে।

এ ছাড়া প্রতি পাঁচ বছরে একবার সিগময়েডোস্কপি করানো দরকার।

ফুসফুস ক্যানসার

এক্স-রে: ফুসফুসের ক্যানসার নির্ণয়ে এক্স-রে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় একটি পরীক্ষা। যেকোনো বয়সীদের, বিশেষত পঞ্চাশোর্ধ্ব, ধূমপায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি কাশি হলে অবশ্যই এক্স-রে করা উচিত।

সিটিস্ক্যান: অধিকতর সূক্ষ্মভাবে ক্যানসারের কোষ নির্ণয়ের জন্য সিটিস্ক্যান একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি।

স্পাটাম সাইটোলজি: রোগীর কফ বা শ্লেষ্মায় ক্যানসার কোষ নির্ণয়ে এ পরীক্ষা কার্যকর।

প্রোস্টেট ক্যানসার

প্রতীকী ছবি

ডিজিটাল রেক্টাল এক্সামিনেশন (ডিআরই): চিকিৎসক রোগীর মলদ্বারে গ্লাভস পরিহিত আঙুল প্রবেশ করিয়ে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তা পরীক্ষা করেন।
প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন (পিএসএ) টেস্ট: এটি একটি রক্ত পরীক্ষা। প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি মনে হলে এ পরীক্ষা করানো জরুরি।

ট্রান্স রেক্টাল বায়োপসি: এটি দিয়ে সন্দেহজনক টিস্যু সংগ্রহ করে পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা যায়।

লক্ষ রাখবেন

অযথা ক্যানসারভীতি ও অহেতুক ক্যানসারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো নয়, উচিতও নয়। কোনো সন্দেহ হলে বা প্রয়োজন হলে প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। কোনো পরীক্ষার দরকার হলে চিকিৎসকই বলবেন।

মনে রাখবেন, কোনো একক পরীক্ষার ওপর ক্যানসার নির্ণয় অথবা বিস্তার ও চিকিৎসা নির্ভর করে না। ক্যানসার অনেক ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য। শুরুতে ধরতে পারলে তো খবুই ভালো। সুতরাং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনাটা চিকিৎসকের কাছেই ছেড়ে দিন। ফলাফল নিজেরা বিশ্লেষণ করবেন না। এতে অনেক সময় মারাত্মক ভুল হয়।

সিনিয়র কনসালট্যান্ট, রেডিয়েশন অনকোলজি, ল্যাবএইড ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ঢাকা